বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা: সম্মুখ সমরে ফিরহাদ–জিতেন্দ্র। একেবারে সরাসরি। কোনও রাখঢাক না করেই। ফল, জিতেন্দ্রকে কলকাতায় তলব করলেন ফিরহাদ। জিতেন্দ্র আসবেন বলে জানিয়েছেন। এর ফলে অস্বস্তি বাড়ল তৃণমূলে।
এবার বেসুরো জিতেন্দ্র তিওয়ারি। পশ্চিমবাংলার আসানসোলের পুরপ্রশাসক। বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র সঙ্গে যাঁর প্রায়ই ঠোকাঠুকি লাগে। কিছুদিন আগে এই জিতেন্দ্রই বলেছিলেন, বাবুল নাকি তাঁকে বলেছেন, তাঁর বিজেপিতে ভালো লাগছে না। তাই তিনি বাবুলকে তৃণমূলে আসার আহ্বান জানান। যদিও বাবুল সুপ্রিয় তাঁর ওই বক্তব্য অস্বীকার করেছেন। বরং জিতেন্দ্র তিওয়ারির তীব্র সমালোচনা করেন। সেই জিতেন্দ্র তিওয়ারির সঙ্গেই নাকি বিজেপির যোগাযোগ রয়েছে। আর সেই অভিযোগ করেছেন কলকাতার পুরপ্রশাসক তথা মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।
নিজের দলের এক সদস্যকে এ ভাবে আক্রমণ করায় থেমে যাননি জিতেন্দ্রও। তিনিও পাল্টা অভিযোগ করেছেন, ফিরহাদের সঙ্গে নাকি পাকিস্তানের যোগ থাকতে পারে। মূল ঘটনার সূত্রপাত একটি চিঠিকে কেন্দ্র করে। চিঠিটি ফিরহাদকে লিখেছিলেন জিতেন্দ্র। কিন্তু কী ছিল সেই চিঠিতে? চিঠিতে জিতেন্দ্রর অভিযোগ ছিল, রাজনৈতিক কারণে আসানসোলকে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা থেকে বঞ্চিত করেছে রাজ্য সরকার। আর সেখানেই নাকি রয়েছে গেরুয়া গন্ধ। তার মানে কি বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার পর এবার জিতেন্দ্রর পালা? তিনিও কি বিজেপির দিকে পা বাড়াচ্ছেন? আর সেই বিষয়টি নিয়ে বাংলার রাজনীতিতে তর্ক–বিতর্ক জমে যায়।
ফিরহাদকে চিঠিতে জিতেন্দ্র লিখেছেন, ‘আসানসোল কেন্দ্রের স্মার্ট সিটি মিশনে জায়গা পেয়েছে। এর পিছনে প্রধান অবদান রয়েছে আসানসোলের কাউন্সিলর ও পুরসভার কর্মী–আধিকারিকদের। তাঁরাই কঠিন পরিশ্রম করে আসানসোলের উন্নয়ন করেছেন। কেন্দ্রের স্মার্ট সিটি প্রকল্পের টাকা পেলে আসানসোলের সামগ্রিক উন্নয়নে বিরাট সুবিধা হত। কিন্তু শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে সেই প্রকল্পের টাকা এবং এবং অন্যান্য সুবিধা নেওয়া হচ্ছে না। এর ফলে আসানসোলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।’ উল্লেখ্য, কোনও শহর স্মার্ট সিটির তালিকায় নথিভুক্ত হলে, সেই শহরের উন্নয়নে ২০০০ কোটি টাকা দেয় কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রক। কিন্তু রাজ্য সরকার সেই টাকা নেয়নি।
পাশাপাশি কেন্দ্রের কঠিন বর্জ্য নিষ্কাশন প্রকল্পে ১৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল আসানসোলের জন্য। সেই টাকাও নাকি স্রেফ রাজনৈতিক কারণে রাজ্য সরকার আসানসোল পুরসভাকে নিতে দেয়নি। এমনই অভিযোগ জিতেন্দ্রর। জিতেন্দ্র জানিয়েছেন, কেন্দ্রের এই সব প্রকল্পের বদলে নবান্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, রাজ্য সরকারই উন্নয়নের গতি অব্যাহত রাখতে টাকা দেবে আসানসোল পুরসভাকে। কিন্তু সেই টাকা তাঁরা পাননি। উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি আসানসোল। চিঠিটি যে রাজ্য সরকারের অনুকূলে নয়, সে কথা বলাই বাহুল্য। স্বভাবতই প্রশ্ন হল, তার মানে কি রাজ্য সরকার মানে তৃণমূলের বিরুদ্ধেই কথা বলছেন জিতেন্দ্র?
সোমবার জিতেন্দ্র তিওয়ারির সেই বিস্ফোরক চিঠিটিই প্রকাশ্যে চলে আসে। কিন্তু এই চিঠি প্রকাশ্যে এলো কী করে? উঠে যায় সেই প্রশ্নও। এ ব্যাপারে মুখ খুলেছেন দু’জনই। ফিরহাদ জানান, চিঠি লেখার আগে জিতেনের উচিত ছিল তাঁর সঙ্গে কথা বলা। কিন্তু জিতেন্দ্র তিওয়ারির দাবি, চিঠিটি সরকারি। আর, তা তিনি গোপনে ফিরহাদকে লিখেছিলেন। সরকারি স্তরে এমন চিঠির আদান–প্রদান হয়েই থাকে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, চিঠিটি ফাঁস হল কী করে? তিনি আঙুল তোলেন ফিরহাদের দিকেই। যদিও ফিরহাদ এ ব্যাপারে কোনও জবাব দেননি।
শুধু তাই নয়, এই ইস্যুতে দু’জনে পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করতে শুরু করেন। ফিরহাদের অভিযোগ, ‘বুঝতে পারছি, অনেকের তৃণমূলে ভালো লাগছে না। তাঁদের হয়তো বিজেপিকে ভালো লাগছে। সে তো ভালো কথা। কারও যাওয়ার থাকলে চলে যেতে পারেন।’ ফিরহাদ এ কথাও জানান, জিতেন্দ্রর চিঠিতে নাকি বিজেপি–যোগ রয়েছে। অর্থাৎ, জিতেন্দ্র তিওয়ারি হয়তো বিজেপিতে চলে যাওয়ারই কৌশল হিসেবে এই চিঠিটি লিখেছেন। এর পরই ক্ষোভে ফেটে পড়েন জিতেন্দ্র। তিনি রীতিমতো সাংবাদিকদের সামনেই ফিরহাদের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে শুরু করেন।
বলেন, ‘আমি যদি ববি (ফিরহাদ) হাকিমকে বলি, তিনি যা করছেন, পাকিস্তানের ইমরান খানের দলের সঙ্গে কথা বলেই করছেন! তিনি আমার নামে যা বলছেন, তা বলতে পারেন না। লোকসভা ভোটের পর সকলেই তো ঘরে ঢুকে গিয়েছিলেন! মনে আছে সে সব কথা? বিজেপি যখন একের পর এক পার্টি অফিস দখল করে নিচ্ছিল আসানসোলে, তখন তাঁরা কোথায় ছিলেন? তখন তো ববি হাকিমকে খুঁজে পাওয়া যায়নি! তখন এই জিতেন্দ্র তেওয়ারিই তো ছিল!’ এমনকী, এমন অভিযোগও জিতেন্দ্র করেন, ফিরহাদের জন্যেই নাকি অনেক ভালো তৃণমূল নেতা দল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
এর পরই জিতেন্দ্র তিওয়ারিকে ফোন করেন ফিরহাদ হাকিম। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কলকাতায় তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি। মঙ্গলবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যামাক স্ট্রিটের দফতরে সেই বৈঠক হবে। বৈঠকে হাজির থাকবেন প্রশান্ত কিশোরও। অন্যদিকে, জিতেন্দ্র–ফিরহাদ বিতর্কে মুখ খুলেছে বিজেপি। তাদের দাবি, এতদিন যে অভিযোগ তারা জানিয়ে এসেছে, তা মেনে নিয়েছেন জিতেন তিওয়ারি। এজন্য জিতেন তিওয়ারিকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন আসানসোলের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়।